মাশরাফির বিদায়ী ম্যাচে জয় উপহার

মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। এই মঞ্চ বাংলাদেশের ক্রিকেট আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মাশরাফির জন্য। খেলবেন কুড়ি ওভারে শেষ ম্যাচ। দেখার বিষয় ছিল মাশরাফির সেই শেষটা কীভাবে হয়। সতীর্থদের চাওয়া ‘প্রিয় নেতাকে’ জয় উপহার দেয়া। মাশরাফিকে এই জয় উপহার দিতে গিয়ে আড়ালেই পড়ে যায় বাংলাদেশের সিরিজ সমতা আনার বিষয়টি। নেতাকে জয় উপহার দিতে পারলে আড়ালে পড়ে যাওয়া সিরিজেও আসবে সমতা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যে রকমটি চাইছেন, শ্রীলঙ্কা কি সে রকমটি হতে দেবে। তারা যে ম্যাচ জিতে সিরিজও জিততে চায়। টেস্ট ও একদিনের সিরিজেও যে নিষ্পত্তি হয়নি। এবারো একই পথে স্বাগতিকরা হাঁটতে চায় না। শেষ পর্যন্ত চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে মিলেছে বাংলাদেশেরই। সরল অঙ্কের যোগফল মেলানোর মতো মুশফিক-মোসাদ্দেক-সৌম্য-মাহমুদউল্লাহরা মিলে মাশরাফির বিদায়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য যা যা করার তারই সবই করেছেন। উপহার দিয়েছেন জয়। ব্যবধানও বেশ বড়। ৪৫ রানে। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নামা অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের বলে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ভিকুম সনজায়ার ক্যাচ ধরার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত হয়ে যায়। সেই সঙ্গে পর্দা নেমে আসে মাশারফির ক্যারিয়ারের। এ সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যেত নাহি দেব’ কবিতার কয়েকটি চরণই যেন মাশরাফির বিদায় বেলা সবাইকে মনে করিয়ে দেয়- এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে, সব চেয়ে পুরাতন কথা, সব চেয়ে গভীর ক্রন্দন- যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়। দুই ওভার বাকি থাকতে শ্রীলঙ্কা ১৩১ রানে অলআউট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জয়ের উল্লাস বা সিরিজ সমতা করায় উৎফুল্ল হওয়ার চেয়ে মাশরাফিকে বিদায় জানাতেই সতীর্থরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেন। ক্যাচ ধরে জয় সূচক উইকেট পাওয়াতে মাহমুদউল্লাহ বা সাইফউদ্দিনের দিকে কেউ দৌড়ে যাননি কিংবা বাহবা জানাননি তাদের। সবার নজর মাশরাফির দিকে। টেলিভিশন ক্যামেরাও মাশরাফির দিকে তাক করা। নেতা তার মাথা থেকে শেষবারের মতো খোলে নেন ক্যাপ। একবার আকাশের দিকে চেয়ে সৃষ্টিকর্তার স্মরণ করেন। এরপর ক্যামেরা যতবার তার দিকে ছিল অধিকাংশই সময়ই মাথা নিচের দিকে ছিল। চোখের পানি সংবরণ করতে পারলেও হৃদয়ে যে অশান্ত ঢেউ বয়ে যাচ্ছে তা ফুটে উঠে তার অবয়বে। বোঝাই যাচ্ছিল হৃদয়ে তখন কান্নার সাগর। এরই মাঝে এক এক করে এগিয়ে আসতে থাকেন মিরাজ, সৌম্য, ইমরুল, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, মোস্তাফিজ, সাকিব, মোসাদ্দেক, সাব্বির ও সাইফদ্দিন। এদিকে ড্রেসিং রুম থেকে দৌড়ে আসতে থাকেন মাশরাফি, তামিম, শুভাশিষ, সানজামুলরা। কেউ বুক মেলাচ্ছেন। কেউ তার বিশাল বুকে শেষবারের মতো আশ্রয় নিচ্ছেন। সবার মন মরা। দেখে বোঝার উপায় নেই এই দলই ৪৫ রানে উড়িয়ে দিয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। যেভাবে সবাই মাশরাফিকে ঘিরে মাঠ ছাড়ছিলেন তা দেখে যে কারো মনে হবে বাংলাদেশ হয়তো বাজেভাবে হেরে সিরিজ হেরেছে! নেতা মাশরাফির বিদায় এভাবে গোটা বাংলাদেশ দলকে আবেগপ্রবণ করে তুলে। বিদায় বেদনার। মাশরাফির জন্যও তাই ছিল। তবে মাশরাফি এই ভেবে সান্ত¡না পাবেন তার বিদায়টা হয়েছে রাজসিক। নিজের কণ্ঠে বিদায় ঘোষণা দিয়েছেন, যা সরাসরি সম্প্রচার হয়েছে। সব শেষে পেলেন জয়। সিরিজে সমতা। এর আগে তার নেতৃত্বে একদিনের সিরিজেও ১-১ সমতা হয়েছে। টেস্ট সিরিজে মুশফিকের নেতৃত্বে ১-১ সমতা। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে সেরা সাফল্য। মাশরাফিকে হারিয়ে ফিরছে ভাণ্ডার পূর্ণ করে।
মাশরাফির বিদায়ী ম্যাচ বলেই হয়তো দলের বাকি ১০ যোদ্ধা তেড়ে-ফুড়ে উঠেছিলেন। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং সর্বত্রই ছিল টাইগারদের দাপট। তাদের দাপটের সামনে স্বাগতিকদের সিরিজ জয়ের স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে যায়। টস জিতে ব্যাট করতে নেমে উড়ন্ত সূচনা। সৌম্য-ইমরুল ব্যাটিং পাওয়ার প্লেকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে ৬৮ রান সূচনা করা। ভাণ্ডারে ৯ উইকেট হারিয়ে ১৭৬ রান সংগ্রহ করা। যেখানে আবার ছিল না কোনো ফিফটি। সর্বোচ্চ ৩৮ রান আসে সাকিবের ব্যাট থেকে। ইমরুলের ২৫ বলে ৩৫, সৌম্য সরকারের ১৭ বলে ৩৪, সাব্বিরের ১৯, মোসাদ্দেকের ১১ বলে ১৭ কিংবা মুশফিকের ৬ বলে ১৫ রানের মাঝেই ফুটে ওঠে টিম বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। পরে বোলিংয়ে নেমে শুরুতেই সাকিবের জোড়া আঘাত (পরে নেন আরো একটি উইকেট)। যে আঘাতে শ্রীলঙ্কার ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে বাংলাদেশের সংগ্রহ। সাকিবের আঘাতের পর মোস্তাফিজের পরপর দুই বলে জোড়া আঘাত করে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা তৈরি করে, পরে ৩ ওভারে ২১ রানে ৪ উইকেট নিয়ে নিজেকে ফিরে পাওয়া, সাইফউদ্দিন-মাহমুদউল্লাহর একটি করে উইকেটের সঙ্গে মাশরাফিও প্রসন্নকে আউট করে নেন ক্যারিয়ারের শেষ উইকেট, মোসাদ্দেক, সৌম্য, মাহমুদউল্লাহ, মিরাজের চমৎকার ক্যাচ- সবই ছিল টিম বাংলাদেশের। মাশরাফির বিদায়ী ম্যাচ না হলে এ ম্যাচের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যেত। কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে সচরাচর এ রকমটি খেলতে দেখা যায়নি বাংলদেশকে। কিন্তু সবই আড়াল পড়ে গেল নেতা মাশরাফির বিদায়ী ম্যাচ হওয়ায়। শুধু কি টিম বাংলাদেশ আড়াল পড়েছে। ইনিংসের শেষের দিকে মালিঙ্গার হ্যাটট্রিকও একইভাবে আড়ালে পড়ে গেছে। ১৯ নম্বর ওভারের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বলে মাশরাফি, মুশফিক ও মিরাজকে আউট করে কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে পঞ্চম ও নিজের প্রথম হ্যাটট্রিক করেন। আগের চারটি হ্যাটট্রিক করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্রেট লি (প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ), নিউজিল্যান্ডের জ্যাকব ওরাম (প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা) ও টিম সাউদি (প্রতিপক্ষ পাকিস্তান) এবং শ্রীলঙ্কার থিসারা পেরারা (প্রতিপক্ষ ভারত)। শুধু কি তাই। মাশরাফি যে প্রথম বলেই আউট হয়েছেন তাই বা কে মনে রেখেছে।
সবার ভাবনার রাজ্যে ছিল একটি বিষয়- এটি মাশরাফির শেষ ম্যাচ। এমন একজন খেলোয়াড়কে সহজে পাওয়া যায় না। আবার কবে পাওয়া যাবে কে জানে?

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর